কবি শিপ্রা পল লাভলী
পাহাড়িকন্যা শিপ্রা পল লাভলী। দার্জিলিং এর শিলিগুড়ির প্রকৃতির প্রাঞ্জল মোহ্নমায়ায় তার কবিতা যেন উচ্ছল আবেগে পাহাড়ের গালবেয়ে নেমে আসে মনের গভীর তলদেশে। বাংলাদেশের উত্তাঞ্চল ঠাকুরগায়ে জন্ম, পড়াশুনা এবং বেডেওটা বাংলাদেেশেই, কিন্তু কবি যেন দুইবাংলাকে একই প্রানের বন্ধনে বেধে রেখেছেন আপন মহিমায়। ছুটে বেড়ান সাহিত্যের তাগিদে দুইদেশের নানা অনুষ্টান আর আড্ডায়।
কবিতায় তিনি প্রণবন্ত জীবনের নীড় বেধে রাখতে চান, তবে গল্প লেখাতেও সিদ্ধহস্ত। আড্ডাপ্রিয় এই কবি বন্ধুমহলে কবিতাকে ভালবেসে আবৃতির জগতকেও আপন করে নিয়েছেন। অনেকগুলো আবৃতি, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত রয়েছেন।
ছোটবেলা থেকে তিনি কবিতায় সাবলীল, লিখছেন দীর্হঘদিন কিন্ত প্রকাশনায় খুব একটা খেয়াল দেননি। নিয়মিত লিখছেন পত্রপত্রিকায়, লিটলম্যাগ সহ অনলাইনের নানা প্ল্যাটফর্মে ।
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ - স্নানের ঘ্ররে নিভৃত উচ্চারণ।
কবিতা
এক অচেনা পথ ধরে
কখনো ডুবে যাওয়া রোদ-জলের ভেতর
বা বৃষ্টি হয়তোবা অন্ধকারে কিংবা ধূপছায়ে
নয়তো গোধূলি-লগ্নের ভেতর
একটা সময়ের পর হারিয়ে হারাই সবকিছু,
আপন থেকে কোনো এক অচেনা পথ ধরে!
কানে মৃদু মাদলের আওয়াজ, পাহাড়ী গানে মহুয়ার গন্ধ
পাখিঘর পাতার ফাঁকে ফাঁকে তাদের কিচিরমিচির,
কেবলই বনকথা
লতায় লতায় জড়িয়ে থাকা হাজার বছরের অভিমান
ডোকরা টেরাকোটার নকশায় প্রতিচ্ছবি,
ঘাসের নরম স্পর্শে হেঁটে যাওয়া বিকেল!!
প্রিয় মুখগুলো আজ বড় দূরবর্তী সঙ্গীহীন,
সাগরের আছড়ে পড়া ঢেউয়ে ভাষা নেই
তবু হাঁটছি একের পর এক সীমানা পেয়িয়ে,
দেবদারু পাইন ছায়ে আবার লালমাটির দেশে
ভরাজলে শতদল দেখেছি কোনো এক প্রভাতে,
চোখে লেপটানো কাজল এখন যদিও প্রসঙ্গহীন
সমস্তটা একটা উপমা বিহীন তরঙ্গ,
দুলছে কেবলই ছুঁতে চাওয়া দৌরাত্ম্যের অধিকারে!
জীবন কখনো নীরব নয়, চলমান অসীম ঠিকানাহীন
আলতো পায়ে ছোপ রেখে দেয়
মুখের আড়ালে মুখোশ ছায়ায় পেছনে
পরছায়া আলোর নীচে অন্ধকার!!
চলো আরো একবার
মৃত্যু ভয় ছুঁতে পারেনা ক্ষিদের হাহাকার’
পরিযায়ী বলে কিছু হয় না
সবটাই বানানো এক পোষণের অধিকার!
বন্দী তো তখনও ছিলাম
ভেতরের ভেতরটা বড্ড আলোহীন
এবং চলো আরো একবার জোছনা কুড়াই!
কিউবিজম
এখন গ্রীষ্মকাল, মাঝেসাঝে বৃষ্টির শীতে ভিজছে বসবাস
পাখিরা আবার বিচরণস্থানে ফিরছে, তাদের নিজেদের মতো
বসন্তবৌরির ডাকে আজকাল ঘুম ভাঙে
যদিও আকাশ দেখা যায় গ্রীলের ফাঁকে!
পিকাসোর কিউবিজমে জুড়ছে ক্যানভাস
মন্থর গতির মালগাড়ি’তে মানবেব দমবন্ধ শ্বাস
ফরাসী থেকে মার্কিন, কমলা সুরাইয়ার বোরখার হেফাজত
সদগুরু এবং ওম ধ্বনির মহাকাল!!
গঙ্গার জল পুনরায় আছড়ে পড়ছে বেলুড়মঠে
যে যার গতি’তে ঠিক হিসেব কষে নেয়
শুধু ছাদ বা ঘরের চাল, একটা হতে অন্যটায় টপকে যাওয়া
বেদনার আধার , দু’টি পথ কিন্তু কেন্দ্রবিন্দু একটি!!
এ কী আশীর্বাদ না অভিশাপ
সব ভাঙছে, শরীর মন সমাজ পরিবেশ
ইতালী খুঁজছে লিওনার্দোর “দ্যা লাস্ট সাপার”
বহুদূর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার আলোয় সেজে ওঠেছে পৃথিবী!
মৃত্যু এবং ভালোবাসার কাছাকাছি
কতোটা দূরত্বে গেলে এড়ানো যায় মৃত্যু’কে
কতোটা কাছে এলে বাঁচানো যায় ভালোবাসা’কে
কতোদিন অভুক্ত অক্ষরগুলো কেবলই ভাসছে
এবার বাছাইয়ের পালা, এবার মুক্তির পথ!
একসাথে সকল ধ্বনি এবং প্রতিধ্বনি
প্রতিটি আত্মা থেকে, যিশু ঈশ্বর বা খোদার দরবারে
কিংবা বিশ্বাসের বক্ষে আঁচড়ে পড়া অ-মৃত বাণী
অথবা ধরে নিতে পারো, লক্ষ্যস্থল একটাই!
যে কথা বলা গেলো না এবং শোনা হলো না
জানালা গলিয়ে আকাশ তাই বড্ড কাছাকাছি
নীরবতারা খসেছে, শেষে শুধুই স্তব্ধতা
আর একঝাঁক সবুজ প্রজাপতির উদযাপন!
চোখের গভীর ছুঁয়ে পাহাড় ছোঁয়ানো ঘ্রাণ
গ্রীল গলিয়ে মানচিত্র, ঠোঁটের ওপর শ্বাস
আর পুনরায় টেনে-নেয়া রাতের সাক্ষী
সব ব্যস্ততার অজুহাত আজ মৃত, সব শূন্যতা অর্থহীন!
গাছের পরে গাছ, তার ভেতরে ঘর—
তবু আসে ফিঙে পাখি, তবু আসে টিয়ে
বুড়ো চাঁদ জোছনার সিঁড়ি নামিয়ে দেয় পৃথিবীতে
একবার রাখো হাত, সুস্থিরতা আর কিছু বিশুদ্ধ উচ্চারণে!
আমি তো আকাশ দেখেছি নিভৃতে
মৃত জোনাকি স্বপ্ন জানে না
সারাদিনে বড্ড ভারী হচ্ছে কথার শব্দ
দীর্ঘ রাত, সরোবরে নোনা জল!!
সেই অপরাহ্ন, একটি স্বরের রঙতুলি
ক্যানভাসে ধূলো-জমা ছবি
আর কিছু লুকোচুরি খেলা!!
গভীরের গভীরতা বাহানার ঢেউ
বঞ্চিত বেদনার আস্ফালন মিথ্যে বালুচর
লু হাওয়ার দাপটে পাগলামি অনুযোগ!
অভিমানী সুর, বড্ড কাঁচার বেদানা
কষের দাগে কষাকষি অরণ্যের সবুজ
হাতছানি দেয়, চশমার দৃষ্টিকোণে।
পরাজয়ের শূন্যহাতে পৃথিবী
বললেই ভালো থাকা যায় না
আমি তো আকাশ দেখেছি নিভৃতে।
নদীর বুকে ঘর
সমস্ত বয়ে যায়, নদীর বুকে ঘর, ঘরের মাঝে আমি
ফুটপাত ছেড়ে নৈঃশব্দ্য মেখে পেরিয়ে যাই জনপথ
একটা সময়ের পর, প্রতিধ্বনি শুধু একটাই
বেঁচে থাকার স্পন্দন,
মুখরিত পাখির ঠোঁট কিংবা ইতিহাসের স্তম্ভে!
জেগে ওঠা সকাল থেকে বিকেলের গেরুয়া রঙে
রাতের কোলাহল শেষে,
নিজেদের কোলাহলে ডোবা
তোমার বহতা পালে লাগে দোলা,
আমার একতারা আর মুষ্টির চাল!