কবি মালেকা ফেরদৌস
১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষাও সাহিত্যে মাস্টার্স করার বহু আগেই মালেকা ফেরদৌসের বাংলা কবিতায় হাতেখড়ি। সময়ের সুদীর্ঘ সরণি অতিক্রম করে তার পরিভ্রমণ আজ সাহিত্যর প্রায় প্রতিটি শাখায়। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে তৎকালীন বরিশালে থেকে প্রকাশিত বরিশাল দর্পন নামক একটি প্রসিদ্ধ পত্রিকায়, তখন তিনি মাত্র ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্রী। ফেরদৌসের স্বদেশ, প্রকৃতিও বৃষ্টি বিষয়ক কবিতাগুলো বাংলা কবিতায় স্বাতন্ত্রের দাবী রাখে।
বরিশালের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয়া কবি মালেকা ফেরদৌসের- এর রয়েছে বিস্তৃত পরিচয়। পিতা প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক,ও ঐতিহাসিক মোঃ ইয়াকুব আলী এবং রাজিয়া বেগম তার জননী। দেশের প্রখ্যাত প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুর রব তার জীবনসঙ্গী, তারা দুই সন্তানের জনক- জননী।
মালেকা ফেরদৌস অক্ষর, গাঁথা, ইনার হুইল ও ঢাকা লেডিস ক্লাবের মতো প্রসিদ্ধ অনেকগুলো সংগঠনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
কবি মালেকা ফেরদৌসের প্রকাশিত কাব্যসমূহ: শব্দ বর্ণ কোলাহল,এই অমৃত এই বিষ,নীল খাম, কবিতা সমগ্র, আশ্চর্য অধীর তুমি, পাখির মতো বৃষ্টিরা উড়ে যায়, স্বদেশ, প্রকৃতিও প্রেমের কবিতা, নির্বাচিত প্রেমের কবিতা। তার অনুবাদ গ্রন্থ: Selected poem of Maleka Ferdous.
কবিতা
নারী
সব শূণ্যতাকে ভরে দিয়ে প্রত্যহ জাগি আমি-
নিলাভ সমুদ্রের ফেনিল শোভায়, প্রকৃতির অমল বালিকা।
আমার সব কবিতা, উৎপ্রেক্ষা উপমার ধ্বনি
তরঙ্গ ভেদ করে জ্বলে উঠি সৌভাগ্যের প্রতীকের মত,
বুকে স্তব্দ জোয়ারের জল,আমি নারী!
পৃথিবীর সব রঙে পুঞ্জরিত আমার দু’চোখ,
নৈঃশব্দের নিগূঢ় ভেঙে মৌনতার অতলস্পর্শী রহস্যের বীজবুনি,
হেঁটে যাই স্বপ্নময় পৃথিবীর দিকে অদম্য - সুঠাম।
আসমুদ্রহিমাচল পেরিয়ে আমি
হয়ে যাই মৃন্ময়ী- এক আশ্চর্য এপিটাফ।
চাঁদের গুঁড়ো
ঘূর্ণী হাওয়ার মত মেয়েটি শাদা পালক হয়ে উড়ছে,
পাথরে সমুদ্রের ঢেউ,সামনের ছাদে স্থির শৈশব,
বুকের ভেতর শব্দ ভীষণ, হাসিতো নয় তরঙ্গ যেন
ছড়িয়ে পড়ে চাঁদের গুঁড়ো,বৃষ্টির সুরে শুধু কলরব।
শাহেরা
(বিচার-প্রার্থী একজন শাহেরা।যিনি জনে জনে ঘুষ দিতে দিতে ক্লান্ত,নিঃশ্ব। যিনি গতকাল বিচারপতির এজলাসে টাকা ছুঁড়ে প্রতিবাদ করেছেন। সেই প্রতিবাদী পাগল নারীকে নিয়ে)
অবশেষে একপাল নেকড়ে আর কাঁটা গুল্মের পথ
পেছনে ফেলে একজন নারী
ঠিক বিচারকের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
মানুষের মত দেখতে কিছু প্রাণী
কাগজের মধ্যে ডুবে আছে শব্দহীন,
একটা দুর্দশাগ্রস্ত কক্ষে ভাঙ্গা মূর্তির মত
বিচারক বসে আছেন, বাইরের কোলাহলে
পুরনো সিঁড়িঘরের কিছু পাখি দিগ্বিদিক উড়ছে…
হঠাৎ ভাঙা তৈজসপত্রের মত ঝনঝনিয়ে
বেজে উঠলো সেই নারীর কন্ঠ-
‘টাকা কি তবে বৃক্ষপত্র? হে ধর্মাবতার ! এই নিন…..
আমি বৃক্ষপত্র তুলতে তুলতে ভীষণ ক্লান্ত!
সাধ্য থাকলে তাবত বৃক্ষের পত্রই দিয়ে যেতাম।
আশপাশের খচ্চর গুলো কৌতুহলী হয়ে উঠলো
রাজার সিপাই পাগলীর কন্ঠস্বরকে অবরুদ্ধ
করতে চঞ্চল হয়ে উঠলো..
একটা বিশাল খাঁচায় বিচারক
লাল পাখি হয়ে উড়বার জন্য পাখা মেললো !
এখন সন্ধ্যা
ঘরের চৌকাঠে নেমে আসে চাঁদ।
তীব্র রোদের দাহে আজ তপ্ত ছিল সব পথ,
সে পথে বানের জলের মত স্বপ্নহীন ভাঙাচোরা
রোবট মানুষের স্রোত নেমেছে রাজধানী অভিমুখে-
মৃত্যুই যেন ডেকেছে তাদের। জনশূণ্য রাজপথ
দূরে কোথায়ও হুইসেল বাজায় রাজার সেপাই।
ঢাকা লকডাউন
জানালায় শুধু আকাশ,কিছু পাখি,দূরে কিছু গাছ
রাত গভীর না হতেই নিদ্রিত সব, নদীর স্রোতের মত
জ্যোস্নার প্লাবন চৌকাঠ বেয়ে ঘর ভরে ওঠে।
সে স্রোতে আমি আমার জীবিত কিংবা মৃত বন্ধুদের
মুখ ভাসতে দেখিl
প্রিয় বাবু, খুশবু হাত নেড়ে চলে যায় আলোর তরঙ্গের ভেতর
এক দুঃখী বন্ধুর কান্নার জল মিশে যায় সেই স্রোতে -
প্রিয় বাুবুর হাত ছুঁতে গিয়ে সেও হারিয়ে যায় অতল জ্যোৎস্নায়।
নির্বাক দেখতে থাকি- চারদিকে বিক্ষুদ্ধ পাখিদের গান ছড়িয়ে পড়ে,
আমি কাউকে খুঁজি- খুঁজলেই বুঝতে পারি সে নেই,
নক্ষত্রের মত জেগে থাকি,
জেগে থাকে বিষন্ন চাঁদ, কিছু প্রাণ।